গ্রীষ্মের দুপুর। রোদের প্রচন্ড উত্তাপে গা পুড়ে যাচ্ছে। তবুও শহরের পিচঢালা পথে পা দুটো অবিরাম চলতে আছে। আশেপাশে কেউ নেই, একদম জনমানবশূন্য। এই ভর দুপুরে রাস্তা একেবারেই ফাঁকা। এই ফাঁকা রাস্তায় হাঁটার মজাই আলাদা। চারিদিকে নিরিবিলি নিস্তব্ধ পরিবেশ। গাছের ডালে পাখির কিচিরমিচির শব্দ। দূর থেকে ভেসে আসা নদীর কলরব। সবকিছু মিলিয়ে যেন এই মধ্য দুপুর এক অনন্য সাঁজে সজ্জিত হয়ে আছে। এজন্য হয়তো দিনের সবচেয়ে সুন্দর সময় দুপুরকে বলা হয়েছে। মনে হয় যেন এই দৃশ্য শিল্পীর নিজ হাতে আঁকা সদ্য ছবি। কোনো শিল্পী যেন তার স্বীয় প্রতিমা ব্যবহার একে রাঙিয়ে তুলেছেন এক অনন্য রুপে।
এই ক্লান্ত দুপুরে সবাই বিশ্রাম নিতে ব্যস্ত থাকলেও সেই সময়টায় কেবল একজন ছুটে চলছেন দূর থেকে দূরান্তে। তার চোখে, মুখে এমনকি শরীরে ক্লান্তির কোনো ছাপ নেই। ক্লান্ত হলে তাকে চলবে না। এই ভর দুপুরে তাকে অনেক পথ পাড়ি দিতে হবে। কিন্তু এই গরমের উত্তাপে পিচঢালা পথ যেন আগুনে রুপান্তরিত হয়েছে। তার উপর খালি পায়ে হেঁটে পা দুটো এখন অবশ হয়ে আসছে। তবুও একে বিশ্রাম দিলে চলবে না। দান যখন করেছ তখন মান তো রাখতেই হবে। খালি পায়ে হাঁটার যথেষ্ট কারণ রয়েছে। বাসা থেকে বের হয়ে এক বৃদ্ধি ব্যক্তিকে খালি পায়ে হাঁটতে কষ্ট হচ্ছে দেখে সে তার নিজের পায়ের জোতা ঐ ব্যক্তিকে দিয়ে এসেছে। তাই এখন খালি ‘পা’ এই অজুহাত দিলে চলবে না। খালি পায়ে না হেঁটে আর উপায় ও নেই। একদিকে পায়ে কষ্ট অনুভব হলেও অন্যদিকে মনে প্রশান্তির বন্যা বইছে। কাউকে সাহায্য করতে পারলেই যেন সে বাড়তি সুখের ভাগিদার হয়ে যায়৷ এই উদ্দেশ্যহীন পথে হাঁটতে হাঁটতে এক সময় ঠিক গন্তব্যে পৌঁছে যাবেন এই আশা মনে রেখে ছুটেছেন দূরন্ত পথিকীনি। হ্যাঁ, বলছিলাম বর্তমান সময়ের জনপ্রিয় গল্পকার “মাহদিয়া আঞ্জুম মাহির” কথা৷ অনলাইন পৌঁটালে লেখালেখি করার মাধ্যমে খুব অল্প সময়ে পাঠকদের মনে তিনি জায়গা করে নিয়েছেন। হাজারো ভক্তের হৃদয়ে স্থান করে আছেন এই লেখক। গল্পের জাদুতে সবাইকে মুগ্ধ করে দিতে পারেন। দেশে আন্দোলন থাকার কারণে আজ গাড়িঘোড়া সব বন্ধ। তাইতো হেঁটে হেঁটে গন্তব্যের দিকে ছুটছেন তিনি।
এই ভর দুপুরে রাস্তার মাঝখানে একজন লোক সন্ন্যাসী বেশে আকাশের দিকে তাকিয়ে আছে। তাকে দেখে মনে হচ্ছে সূর্যের আলোতে হারিয়ে যাওয়া কোনো জিনিস খোঁজার আপ্রাণ চেষ্টা চালিয়ে যাচ্ছেন। কিন্তু কি এমন জিনিস যার কাছে এই প্রচন্ড রোদের উত্তাপ কিছুই না৷ যা একজন মানুষকে তার প্রকৃতি থেকে আলাদা করে দিতে পারে। প্রকৃতির এই উত্তাপ তাকে আটকে রাখতে পারে নি। কিছু না ভেবে আমি লোকটির সামনে গিয়ে দাঁড়ালাম। মাথা ভর্তি লম্বা চুল, মুখ ভর্তি দাড়ি আর গোঁফের কারণে তার চেহারাটা ঠিক বোঝা যাচ্ছে না। কিন্তু চোখ দুটি ভীষণ পরিচিত মনে হচ্ছে। তার মুখের মায়াবী হাসিটাও বড্ড আপন লাগছে৷ কিন্তু কে এই ব্যক্তি? কেন আমার এত পরিচিত মনে হচ্ছে? আমি যে তাকে এত খুঁটিয়ে খুঁটিয়ে দেখার চেষ্টা করছি সে কি আদৌ সেটা খেয়াল করে দেখেছে.!!
এই যে শুনছেন? লোকটি আমার দিকে এক পলক তাকিয়ে আবার চোখ সরিয়ে আকাশের দিকে তাকিয়ে বলতে লাগলো ‘ নীলাদ্রি তুমি কেন আমাকে ছেড়ে আকাশের তারা হয়ে গেলে? এটা তো কথা ছিল না। তাহলে কেন আজ আমাকে নিঃস্ব করে চলে গেলে? এতটা অভিমান করলে আমার সাথে। এই বলে সে পাগলের মতো হাসতে লাগলো।
লোকটার কথা শুনে আমার বুকের ভেতর ভুমিকম্প শুরু হলে গেল। কণ্ঠ শুনার পর আমার আর বুঝতে বাকি রইল না মানুষটা কে? হ্যা, এই সন্ন্যাসী বেশে লোকটিই আমার আবির৷ আমার ভালোবাসা। আবির আমার সেই ভালোবাসা যার হাত ধরে সারাজীবন পার করার দৃঢ় প্রতিজ্ঞা করেছিলাম একসময়। যার বুকে মাথা রাখলে পৃথিবীর সবচেয়ে সুখী মানুষ মনে হতো নিজেকে। যার জন্য আমার এই পৃথিবীতে জন্ম স্বার্থক মনে হতো। যে পাশে থাকলে মনে হতো সারাবিশ্ব আজ আমার আঙ্গিনায়। আবির আমাকে নীলাদ্রি আর আমি তাকে নীলদরিয়া বলে ডাকতাম। আমার সবচেয়ে কাছের মানুষ, আমার স্বপ্ন, আমার ভালোবাসা, আমার সবকিছু ঘিরেই রয়েছে একমাত্র আবির। কিন্তু শেষ দেখা যে এভাবে রাস্তার হবে সেটা আমি কল্পনাও করতে পারি নি। আজ যে রাস্তায় দাঁড়িয়ে আবির আমাকে আকাশে খুঁজার আপ্রাণ চেষ্টা করছে একসময় এই রাস্তাটা ছিল আমাদের ভালোবাসার সাক্ষী। ঐ নদীর পাড়ে, খোলা মাঠে, সবুজ ঘাসে সবকিছুর মধ্যেই মিশে আছে আমাদের ভালোবাসার স্মৃতি। রমনার বটমূল থেকে কদমফুল কুড়িয়ে এনে আমার কোপাতে গুঁজে দেওয়া একমাত্র মানুষটিই ছিল আবির। আমাদের গল্পটা পুরোপুরি জানতে হলে ফিরে যেতে হবে কিছু অতীতে….!
আবির আর আমার পথচলা শুরু হয়েছিল সেই স্কুল জীবন থেকে। পাশাপাশি গ্রামে আমরা বাস করতাম। আবির ছিল একটি মধ্যবিত্ত পরিবারের সন্তান আর আমি ছিলাম বড়লোক বাবার একমাত্র সন্তান। আমাদের পারিবারিক অবস্থা যেরকমই হোক না কেন আমাদের ভালোবাসা ছিল একদম খাঁটি। আমরা দুজন ছিলাম একি সুতায় গাঁথা দুটি ফুল। আবির প্রতিদিন স্কুলে যাওয়ার সময় আমার জন্য রাস্তায় দাঁড়িয়ে থাকতো তারপর আমি আসলে দুজন একসাথে স্কুলে যেতাম। প্রতিদিন আমরা একসাথে আসা যাওয়া করতাম। এভাবে স্কুল শেষ করে আবার একই কলেজে দুজন ভর্তি হলাম। আমাদের ভালোবাসা আস্তে আস্তে আরো মজবুত হতে শুরু করলো। একজন আরেকজনকে একনজর না দেখলে আমাদের দিনটাই বৃথা হয়ে যেত। দুজন এবার ইন্টারমিডিয়েট পাস করলাম। এরপর থেকে আমাদের গন্তব্য আলাদা হয়ে গেল। আবির এডমিশন নিলো একটি পাবলিক ইউনিভার্সিটিতে আর আমি এডমিশন নিলাম মেডিকেল কলেজে। আবির চলে গেল ঢাকায় আর আমি রয়ে গেলাম সিলেটে। প্রতিটি মুহূর্তে আমাদের যোগাযোগ হতো ঠিকি কিন্তু দেখা হতো খুব কম। এভাবে কেটে গেল দুটি বছর।
পড়াশোনার পাশাপাশি আবির একটি প্রাইভেট কোম্পানিতে জব শুরু করলো। আমরা সিদ্ধান্ত নিলাম আমাদের ভালোবাসার একটি নাম দিতে। আমাকে নিয়ে আবিরের অনেক হারানোর ভয়। তাই সে চায় আমাকে তার নিজের করে নিতে। আমিও চাই আমাদের মধ্যে যে দূরত্ব রয়েছে তার সমাপ্তি ঘটাতে। পরেরদিন বাসায় এসে বাবাকে আবিরের কথা জানালাম। বাবাকে দেখে মনে হলো আমাদের রিলেশনটা তিনি সহজ ভাবেই নিয়েছেন। আবিরের সাথে দেখা করতে বাবা রাজি হয়ে গেলেন৷ তারপর আবিরকে আমাদের বাসায় ডিনারের দাওয়াত দেওয়া হলো আর পাশাপাশি আমাদের বিষয় নিয়ে আলোচনা করবেন বলে বাবা আমাকে জানিয়ে দিলেন ।
আবিরের সাথে বাবাকে পরিচয় করিয়ে দিলাম। আজ আবিরকে অনেক সুন্দর লাগছে। মনে হচ্ছে পৃথিবীর সবচেয়ে সুন্দর আর সুদর্শন পুরুষটি এখন আমার সামনে দাঁড়িয়ে আছে। আমার বিশ্বাস আবিরকে বাবার পছন্দ হবেই। অপছন্দ হওয়ার কোনো কারণ আমি দেখতে পাচ্ছি না। দুজনকে আলোচনায় রেখে আমি চলে গেলাম ডিনার সাজাতে।
কিছুক্ষণ পর তাদেরকে ডাকতে এসে আমি নিজেই স্তব্ধ হয়ে গেলাম। বাবা মুখ কালো করে বসে আছেন আর আবির চলে গেছে। আমার অনুপস্থিতিতে এই অল্প সময়ে কি এমন হলো যে বাবা মন খারাপ করে বসে আছেন। আমি সামনে গিয়ে বাবাকে জিগ্যেস করলাম আবির কোথায়। বাবা আমার কথার কোনো জবাব না দিয়ে আমার দিকে একটি চিঠি এগিয়ে দিলেন৷ চিঠি হাতে নিতেই আমার ভেতরটা কেঁপে উঠলো। উল্টাপাল্টা কিছু হয় নি তো? নানান রকমের প্রশ্ন জাগতে শুরু করলো আমার মনে। তারপর চিঠিটা খুলে পড়তে লাগলাম…
পিয়তমা,
আমাকে ক্ষমা করে দিও। তোমার অজান্তেই আমি তিনমাস আগে একটি মেয়েকে বিয়ে করে ফেলছি। অনেক বার তোমাকে বলার চেষ্টা করেছি কিন্তু তোমার সামনে সত্যিটা বলার সাহস পাইনি। তাই আজ আমাকে চিঠির আশ্রয় নিতে হলো। তুমিও তোমার বাবার পছন্দের ছেলেকে বিয়ে করে সুখি হও দোয়া করি। আর পারলে আমাকে ক্ষমা করে দিও আর হে কখনো আমাকে খুঁজার চেষ্টা করবে না। আশা করি তুমি আমার পরিস্থিতিটা বুঝতে পারবে। ভালো থেকো।
ইতি
আবির
সামান্য কয়েকটি অক্ষরে চিঠিটা লেখা হয়েছে কিন্তু এই অল্প কয়েকটি লেখা পড়তে গিয়ে মনে হচ্ছে পৃথিবীর সবচেয়ে কঠিন কোনো জিনিস আমি পড়ছি এখন। প্রতিটি শব্দের মধ্যে আমার ধ্বনি আটকে আসছে। লেখাগুলো আবিরের হাতের লেখা সেটা বুঝতে পারছি কিন্তু এটা তার মনের কথা হতে পারে না। আমি বিশ্বাস করি না। নিশ্চয়ই বাবা আবিরকে কিছু একটা বলেছেন। চিঠি রেখে বারবার আবিরকে ফোন দিতে লাগলাম কিন্তু বার বার সুইচ অফ দেখাচ্ছে। সেদিনের পর থেকে ১ সেকেন্ডের জন্য ও আবিরের ফোনটা অন হয়নি। তারমানে আবির সত্যিই আমার সাথে প্রতারণা করলো। আমার ভালোবাসায় কোনো কমতি ছিল না তবুও আবিরের হয়তো কোথাও ঘাটতি রয়ে গেছে তাইতো সে আমাকে সস্তা ভেবে আজ ডাস্টবিনের ময়লার মতো ফেলে গেল। একবারও ভাবলো না আমি কি নিয়ে বাঁচবো। এই পৃথিবীর সবাই স্বার্থপর। আবিরের প্রতি এখন আমার মনে ঘৃণা জন্ম নিতে শুরু করলো।
আমি পড়াশোনা শেষ করলাম। নতুন চাকরিতে জয়েন করলাম। পাশাপাশি সাহিত্য অঙ্গনে যোগ দিলাম। সবার কাছে একজন গল্পকার হিসেবে বেশ পরিচিত হলাম। একসময় আমার প্রতিটি গল্পের পাঠক ছিল আবির কিন্তু তখন আমি ছিলাম শুধুই একজন স্টুডেন্ট আমাকে কেউ চিনতো না। কিন্তু আজ আমি একজন লেখক সবাই আমাকে চিনে অথচ আবিরের কাছে সেটা অজানা রয়ে গেল। আজ আবির পাশে থাকলে হয়তো অনেক খুশি হতো আর আবিরের ছোঁয়ায় আমার গল্পগুলো পূর্ণতা খুঁজে পেত। কিন্তু পৃথিবীতে কখনো কখনো এমন কিছু ঘটে যা কল্পনার বাহিরে। অবিশ্বাস হলেও সত্যি। আজ আমি নির্মম বাস্তবতার শিকার।
এদিকে বাবা আমাকে বিয়ের জন্য চাপ দিচ্ছেন, কিন্তু আমি আর কোনোদিন কোনো বন্ধনে আবদ্ধ হবো না বলে বাবাকে স্পষ্ট জানিয়ে দিলাম। তবুও বাবা একের পর এক পাত্র দেখা শুরু করছেন। কিন্তু বাবা যাই করুক না কেন বিয়ে আমি করবো না। যাকে একবার অন্ধের মতো বিশ্বাস করছিলাম সেই আজ আমাকে অন্ধ প্রমাণ করে দিল সেখানে অন্য কাউকে নতুন করে বিশ্বাস করা আমার পক্ষে অসম্ভব। বাকি জীবনটা আমি সাহিত্য আর মানুষের সেবা করে কাটিয়ে দিতে চাই। মানুষের ভালোবাসা নিয়েই আগামী দিনগুলো পার করে দিব। আমার জীবনে কাউকে প্রয়োজন নেই। আমার কাউকেই পাশে লাগবে না।
কিছুদিন পর পত্রিকা অফিসে আবিরের বন্ধু সজলের সাথে আমার দেখা হলো। সজল ভাইয়ের কাছ থেকে জানতে পারলাম সেদিনের সেই ঘটনাগুলো ছিল সাজানো নাটক। আবির ছিল পরিস্থিতির স্বীকার তাই সে বাধ্য হয়ে বাবার কথায় এমন চিঠি আমাকে লিখে আমার অজান্তেই আমার জীবন থেকে সড়ে গেছে। এরপর অনেক জায়গায় আবিরকে হন্যে হয়ে খুঁজেছি কিন্তু কোথাও পাইনি। অথচ আজ ওর সাথে আমার কত সহজ ভাবেই না দেখা হলো। ওর সাথে এভাবে দেখা হবে তা ভাবতেও পারি নি৷ আমি তাকে চিনতে পারলেও আবির আমাকে চিনতে পারেনি। সেদিনের পর একটা রোড এক্সিডেন্টে আবির তার স্মৃতি শক্তি হারিয়ে পাগলের মতো রাস্তায় রাস্তায় ঘুরে বেড়ায়। হয়তো নিয়তিই চায়নি আমরা এক হই। প্রকৃতি হয়তো আমাদের মিলন মেনে নিতে পারে নি। তাইতো আজ আমরা একই দেশে প্রবাসীদের মতো দূরত্ব নিয়ে বেঁচে আছি। এতটা কাছে তবুও পাহাড় সমান দূরত্ব আমাদের মাঝে। হয়তো এটাই হওয়ার কথা ছিল..!!
লেখকঃ মাহদিয়া আঞ্জুম মাহি, ছাত্রী, সুনামগঞ্জ সরকারি মহিলা কলেজ।