বুধবার, ২৭ জানুয়ারী ২০২১, ১২:৪১ পূর্বাহ্ন
একটি মেয়ে জন্মের পর থেকে অবহেলিত, লাঞ্ছিত ও বঞ্চিত থাকে বিভিন্ন দিক থেকে। প্রতিনিয়ত তাকে কোন না কোনভাবে সমাজের কতিপয় মানুষের কাছে হেয় প্রতিপন্ন হতে হয়। জন্মের পর থেকে মৃত্যুর আগ পর্যন্ত সময়টায় তাকে নানান রকমের বৈষম্যের স্বীকার হতে হয়। একটি মেয়ের চেহারা যদি দেখতে খারাপ হয়, রূপ যদি গুণের চাইতে কম হয় তাহলে তার বিরুদ্ধে হাজারো আঙ্গুল তুলতে কেউ দ্বিধাবোধ করবে না। পরিবারে, সমাজে, রাষ্ট্রে তার স্থান যে সর্বনি¤œ স্থরে অবস্থান করবে সেই বিষয়ে কোনো সন্দেহ নেই বললেই চলে। চলার পথে হাজারো বাঁধার সম্মুখীন হতে হয়। বর্তমান সমাজের দিকে লক্ষ্য করলে দেখা যায়, নারী-পুরুষদের মধ্যে ভেদাভেদ আমরা নিজেরাই তৈরি করে নিচ্ছি। যদিও বর্তমান সরকার ঘোষণা দিয়েছেন নারী-পুরুষের সমান অধিকার রয়েছে, কিন্তু বাস্তবে সেই ঘোষণা কতটুকু কার্যকর? একটি পরিবারে যখন সন্তান আসার সম্ভাবনা দেখা দেয় তখন দেখা যায় পরিবারের প্রত্যেকটি সদস্য অত্যন্ত আনন্দে আত্মহারা হয়ে থাকেন। প্রতীক্ষার প্রহর গুণেন কখন অনাগত সন্তান আলো দেখবে পৃথিবীর আর তাকে কোলে নিয়ে আদর করবেন। তখন দেখা যায় অনাগত সন্তানের মায়ের সেবার অভাব হয় না। যে স্বামী তাকে অবহেলা করতো সেও এখন তার প্রতি যথেষ্ট যতœশীল। সব অপেক্ষার অবসান কাটিয়ে যখন একদিন সন্তানটির আগমন ঘটে পৃথিবীতে একটি মেয়ে হয়ে তখন দেখা যায় পরিবারের সদস্যদের আনন্দ মাখা মুখটা মুহূর্তের মধ্যে মলিন হয়ে যায়। উজ্জ্বল চেহারার মধ্যে হঠাৎ যেন কালো মেঘের ছায়া পড়ে। তার জন্য আবার অনেকেই নবাগত সন্তানের মা কে দোষারোপ করেন। যদিও কিছুটা বদলেছে এই প্রবণতা। তবুও কিছু কিছু পরিবারে এ অবস্থা রয়েই গেছে। এর কারণও আছে বটে। কারণ, ছেলেরা নাকি হচ্ছে হাতের শক্ত লাঠি, আর কতিপয় পরিবারে ‘মেয়েরা হচ্ছে পিঠের বোঝা। যা বইবার ক্ষমতা তাদের নেই। একসময় পরিবারের হাল ছেলেরাই ধরবে বলে মনে প্রাণে বিশ্বাস করেন তারা। আর মেয়েরাতো বিয়ের পর বাবার বাড়ি ছেড়ে শ্বশুর বাড়ি চলে যাবে। এ জগৎ সংসারে তার কোনো অবদান থাকতে পারে না, তাদের মতে থাকার কথাও না। এ কেমন নিষ্ঠুরতার বেড়াজালে আটকে পড়লাম আমরা মেয়েরা?
আমার নিজের দেখা একটি শিক্ষিত দম্পত্তি পর পর দুটি ফুটফুটে কন্যা সন্তানের বাবা মা হওয়ার পরও পুত্র সন্তানের আশায় তারা তৃতীয়বার আবার বাচ্চা নেন। বৃদ্ধ বয়সে নাকি শুধু ছেলেরাই বাবা-মার দায়িত্ব নিবে, দেখাশোনা করবে। তাদের মতে মেয়েরা কোনো দায়িত্ব নিতে পারে না। কাজেই মেয়েদের চেয়ে ছেলেদের গুরুত্ব বেশি সংসারে। যেখানে নিজের বাবা-মায়েরা সন্তানের লিঙ্গের ভেদাভেদ করে তাদের সন্তানদের বড় করে তুলছেন সেখানে সেই সন্তানেরা সমাজের কাছ থেকে, দেশের কাছ থেকে কি আশা করতে পারে সেটা আমার বোধগম্য নয়।
তবে হ্যাঁ, সব বাবা-মা এবং পরিবার একরকম না এটা যেমন সত্যি, তেমনি সব ছেলেমেয়ে সমান অধিকার ও গুরুত্ব পেয়ে বেড়ে ওঠতে পারে না এটাও কিন্তু অপ্রিয় হলেও বাস্তব সত্যি। দেখা যায়, একটি ছেলের পড়াশোনার পিছনে তার পরিবার যতোটা গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করেন ঠিক ততটাই অবহেলা ও খামখেয়ালি করেন মেয়েদের পড়াশোনার ক্ষেত্রে। বেশির ভাগ ক্ষেত্রে এই প্রচলনটা গ্রামাঞ্চলে বেশি লক্ষ্যে করা যায়। সেখানে মেয়েদের পড়াশোনার প্রয়োজন হয় না। তাদের সর্বোচ্চ ডিগ্রি হচ্ছে এসএসসি পর্যন্ত। এর বেশি মেয়েদের পড়াশোনার দরকার কি? বিয়ে দিয়ে তো একদিন পিঠের বোঝা অন্যের ঘরে পাঠাতেই হবে। তাহলে টাকা কড়ি ব্যয় করে পড়াশোনা করানোর সার্থকতা কি?
সে সমাজে তাদের সম্পর্ক হচ্ছে রান্না ঘরের সাথে, বহির্জগতের সাথে নয়। এরকমের মন মানসিকতা দেখা যায় বিভিন্ন পরিবারে। অনেক মেধাবী শিক্ষার্থীর জীবন অকালে ঝড়ে পড়ে এহেন অমানবিক সিদ্ধান্তের ফলে। ফুল ফোঁটার আগেই যে ফুল ঝড়ে পড়ে সেখান থেকে আবার সুভাষ আশা করাটাও বৃথা। দারিদ্রতা বলো কিংবা অসহায়ত্ব যেকোনো একটির অজুহাত দেখিয়ে অপ্রাপ্ত বয়সে বিয়ে দিয়ে দেওয়া হয় অনেক মেয়েদের। যে বয়সে নিজেকে একজন যোগ্য নাগরিক হিসেবে সমাজে গড়ে তুলার কথা, সেই বয়সে শ্বশুর বাড়ির লোকের মন জুগিয়ে নিজেকে যোগ্য বউ হিসেবে প্রমাণ করতে ব্যস্ত তারা। যে সময়টাতে হাতে কলম থাকার কথা সেই সময়টাতে সেই হাত দিয়ে বাচ্চা সামলাতে হচ্ছে তাদের। কিন্তু কেন মেয়েদের বেলায় এমন অবিচার হবে? এসব পরিস্থিতির পিছনে কারা দায়ী? পরিবার, সমাজ, রাষ্ট্র নাকি আমাদের মতো কিছু সাধারণ মানুষের অসচেতনতার কারণে এসব পরিস্থিতির তৈরি হচ্ছে সমাজে? মেয়েদের ক্ষেত্রে কেন এরকম অমানবিক সিদ্ধান্ত গ্রহণ করা হবে? আপনাদের অসাবধানতার কারণে, অজ্ঞতার ফলাফল কেন নারীদের জীবন অকালে থমকে যাবে? এটা একজন নারী হিসেবে কিছুতেই মেনে নিতে পারিনা।
এবার বলি আমরা মেয়েরা কি চাই? বিয়ের আগে বাবার পরিচয় এবং বিয়ের পর স্বামীর পরিচয় ছাড়াও আমরা চাই বহির্জগতে আমাদের একটি সুপরিচিতি তৈরি হোক। যে পরিচয় দিয়ে বাহিরে মাথা উঁচু করে দাঁড়াতে পারবো, পরিচিত হতে পারবো। আমাদের অস্তিত্ব শুধু ঘরের মধ্যে সীমাবদ্ধ থাকলে চলবে না, আমরা চাই ঘরের বাহিরেও আমাদের অবদান থাকুক। তার জন্য প্রথমে আমাদের শক্ত হতে হবে, নিজের সাথে যুদ্ধ করতে হবে প্রতিনিয়ত। অন্যায়ের বিরুদ্ধে সোচ্চার হতে হবে। নিজের প্রতি আস্থা, বিশ্বাস এবং ভরসা রাখতে হবে। পরিবারের এমন অন্যায় আবদার মেনে নিয়ে আমরা আমাদের জীবনকে ধ্বংসের পথে এভাবে ঠেলে দিতে পারি না। আমাদেরকে নিজের যোগ্যতায় প্রমাণ করতে হবে, ছেলেদের চেয়ে মেয়েদের ভূমিকা কোনো অংশে কম নয়। চাইলে আমরাও পরিবারের হাল ধরতে পারি। বাবা মায়ের দায়িত্ব আমরাও নিতে পারি৷
ইতিহাস ঘাটাঘাটি করলে দেখা যায়, পুরুষদের বড় বড় সাফল্যের পিছনে নারীদের অসামান্য ভূমিকা রয়েছে। তাই, নারী তুমি নিজেকে দূর্বল ভেবো না। তুমি ছাড়া পুরুষজাতি অচল। মনে রাখবে তোমার শিকড়েই জন্ম নিবে আগামী দিনের ভবিষ্যৎ। সাফল্যের উজ্জ্বল দৃষ্টান্ত তুমি নিজেই। তুমি হয়তো নিজেও জানো না তোমার গুরুত্ব কতটুকু। তুমি ছিলে, তুমি আছো, তুমিই থাকবে। জীবনটা তোমার। তাই জীবনকে সাজানোর দায়িত্ব তোমাকেই নিতে হবে। নিজেকে প্রতিষ্ঠিত করতে হলে যুদ্ধ করতেই হবে। কষ্ট ব্যতীত কেষ্ট মিলে না। জীবনটা তোমার- তাই নিজের জীবনের সিদ্ধান্ত কখনো অন্যের হাতে তুলে দিয়ে নিঃস্ব হয়ে যেয়োনা। তুমি ছিলে, তুমি আছ এবং তুমিই থাকবে.!!
লেখক: শিক্ষার্থী, সুনামগঞ্জ সরকারি মহিলা কলেজ।