মঙ্গলবার, ২১ মার্চ ২০২৩, ০৩:৪৫ পূর্বাহ্ন

গল্প : নীলপদ্ম : মাহদিয়া আঞ্জুম মাহি

গল্প : নীলপদ্ম : মাহদিয়া আঞ্জুম মাহি

Nirvana

ভালোবাসার বহিঃপ্রকাশ হচ্ছে লাল গোলাপ। প্রত্যেকটি মেয়ে হচ্ছে গোলাপের রাণী। আর রাজা হচ্ছে সেই টকটকে লাল গোলাপ ফুলটি। প্রিয়জনের সাথে যতই রাগ অভিমান করুক না কেন, সেই মুহূর্তে প্রিয় মানুষের হাত থেকে পাওয়া একটি টকটকে লাল গোলাপ পারে সব রাগ অভিমানের অবসান ঘটাতে। এই গোলাপ ছাড়া যেন কোনো ভালোবাসাই পূর্ণতা খুঁজে পায় না। ভালোবাসার মানুষের কাছ থেকে পাওয়া প্রথম স্পর্শের ছোঁয়া হচ্ছে লাল গোলাপ। প্রেমের শুরুতেই এই গোলাপটাকে সবাই ব্যবহার করে। কেউ কেউ ভালোবাসার প্রথম স্মৃতি হিসেবে ডাইরির ভাঁজে রেখে দেয় গোলাপের পাপড়ি গুলো। অবসর সময়ে যখন প্রিয় মানুষটির কথা মনে পড়ে তখন ডাইরির ভাঁজের এই শুকনো পাপড়ি গুলো সব ক্লান্তির ভেতর নিয়ে আসে প্রশান্তির ছোঁয়া। খুব কম সংখ্যক মানুষ আছেন যারা গোলাপ ফুলকে অপছন্দ করেন।

একটি সবুজ সতেজ গাছ থেকে পেরে আনা টকটকে লাল গোলাপ হাতে নিয়ে রাস্তার পাশে দাঁড়িয়ে আছে রিফাত নামের ছেলেটি। একটু সময় পর রিয়া এই রাস্তা দিয়ে হেঁটে কলেজে যাবে। রিয়াকে সে ছোটবেলা থেকে ভালোবেসে আসছে  কিন্তু সাহস করে মুখ ফুটে সেই ভালোবাসা কোনোদিন  প্রকাশ করতে পারে নি। এখন সে ভেবে দেখলো, অনাবাদি জমি যদি সে চাষ না করে তাহলে পাশের বাড়ির কৃষক কিন্তু বসে থাকবে না৷ অর্থাৎ কেউ না কেউ তার জীবনে চলে আসতে পারে। সময়ের উপর কোনো ভরসা নেই৷ অনেক সময় এমন কিছু ঘটে যার জন্য পূর্ব থেকে প্রস্তুতির কোনো প্রয়োজন হয় না৷ তাই আজকে বুক ভরা সাহস আর মনে প্রচুর জোর নিয়ে হাজির হয়েছে রিয়ার আসা যাওয়ার পথে। আজ রিয়াকে তার ভালোবাসার কথা জানাতেই হবে ।  রিয়াকে সে কি কি কথা বলবে সব কিছু বাসা থেকে মুখস্থ করে এসেছে। কিছুক্ষণ পর দেখা যাচ্ছে রিয়া এদিকে আসছে। রিয়াকে দেখে রিফাতের বুক ধড়ফড় শুরু করলো। মুখস্থ করে আসা গুছানো সব কথাগুলো মুহূর্তের মধ্যে এলোমেলো হয়ে গেল। এদিকে রিয়া আস্তে আস্তে কাছে চলে এসেছে। রিফাত কিছু না ভেবেই রিয়ার পথ আগলে গিয়ে তার সামনে দাঁড়াল।
-রিয়া আমি তোমাকে আজকে কিছু কথা বলতে চাই।
–কিছু কেন? যতটুকু মন চায় বলতে পারেন।
– রিফাত বলতে লাগলো, আসলে তোমাকে অনেক দিন ধরে একটি কথা বলতে চাচ্ছি কিন্তু সাহস করে বলতে পারছি না কিছুটা ভয় আর কিছুটা সংকোচ থাকার কারণে।
— কিন্তু কথাটা কি সেটাতো বলুন!
 – তুমি অনেক সুন্দর। তোমার চোখগুলো ভীষণ মায়াবী। আমি সেই ছোটবেলা থেকে তোমার প্রেমে পড়ে আছি। বিশ্বাস করো আমি তোমাকে অনেক অনেক ভালোবাসি। তোমাকে ছাড়া আমার বেঁচে থাকা প্রাণহীন দেহের মতো।
— আর কিছু?
গোলাপটি এগিয়ে দিয়ে রিফাত বলতে লাগলো, -আমি তোমাকে ভালোবাসি রিয়া। আমার ভালোবাসার লালা গোলাপটি তুমি গ্রহণ করো।
— রিয়া রিফাতের কথা শুনে হাহাহা করে হাসতে লাগলো। আচ্ছা এই যে আপনি কথাগুলো বললেন সেটা বাংলা কোন সিনেমার ডায়লগ ছিল?
– আমি বাংলা সিনেমা দেখি না। আর আমি যা বলছি সব সত্যি। একটু বিশ্বাস করো প্লিজ।
— আরে ভাই থামেন তো। এত পকপক করছেন কেন? তারপর রিয়া বলতে লাগলো, শুনুন এই সব ডায়লগ অনেক পুরাতন হয়ে গেছে এগুলো বাদ দিয়া নতুন কিছু প্রাকটিস করুন। আর এই যে লাল গোলাপ এটাও কমন একটি ফুল। সবাই এই ফুল দিয়া প্রথমে প্রপোজ করে, এবার আপনি নতুন ফুল দিয়া ট্রাই করুন। এক জিনিস আর কত ব্যবহার করবেন? আর তারচেয়ে বড় কথা হলো আমি আনকমন জিনিস পছন্দ করি। তাই আমি আপনার এই কমন জিনিসগুলো গ্রহণ করতে পারলাম না। এই বলে রিয়া ঠোঁটের কোণে মৃদু হাসি দিয়ে এখান থেকে চলে গেলো।
লাইব্রেরিতে বসে রিয়া বই পড়ছিল। হুমায়ুন আহমেদ স্যারের হিমু সমগ্র বইটা সে মন দিয়ে পড়ছে। হিমু একটি আজব ক্যারেক্টার। অনেক ইন্টারেস্টিং কিন্তু মাঝে মাঝে  খুবই বিরক্তিকর। আচ্ছা একটা মানুষ কিভাবে এত উদাসীন হয়? আর রুপার মতো মেয়েও তাকে ভালোবাসা বন্ধনে আবদ্ধ করে রাখতে পারলো না। পারবেই বা কি করে। মানুষটার স্বভাব হচ্ছে ভবঘুরে। আর একজন ভবঘুরে মানুষকে কখনো ঘরে কিংবা  কোনো সম্পর্কের বন্ধনে বেশিদিন বন্দী করে রাখা যায় না। হঠাৎ করে পেছনে একজন রিয়া বলে ডাক দিলো। আশ্চর্য! এই অসময়ে আবার কে আমাকে খুঁজতে আসলো। পিছনে ফিরে তাকাতেই দেখলাম সিফাত আমাকে ডেকে ডেকে লাইব্রেরির দিকে আসছে। এই সিফাত ছেলেটাও অনেক বিরক্তিকর। সময়ে অসময়ে বিরক্ত করে। তবে বেশ কিছুদিন ধরে সে আমাকে একটু বেশিই বিরক্ত করছে। আরে ভাই একটু মনোযোগ দিয়েও কি আমাকে বই পড়তে দিবি না? সবসময় তর আমাকে খুঁজতেই হবে?
সিফাত এসে আমার সামনে বসলো। তারপর সে বলতে লাগলো, রিয়া গত সপ্তাহে যে তোমাকে একটি কথা বলেছিলাম তার উত্তর এখনও দিলে না কেন? তোমার কিসের এত অহংকার আর আমার কিসের এত অভাব যায় কারণে তুমি আমাকে এভাবে এড়িয়ে চলো?
–কোনটার উত্তর আগে দিবো?
– মানে?
— মানে হলো তুমি আমাকে একসাথে তিনটা প্রশ্ন করেছো, কোনটার উত্তর আগে দিবো?
– আচ্ছা রিয়া সবসময় তোমার ফাজলামো না করলে হয় না!.
— আজব! আমি ফাজলামো করতে যাবো কোন দুঃখে? তোমার সাথে কি আমার ফাজলামো করার সম্পর্ক?
– এত পেচিয়ে কথা বলো কেন৷ আচ্ছা বাদ দেও। এবার উত্তর দাও!
— সরি সিফাত ভাইয়া আমার একটু তাড়া আছে। আজ চলি অন্যদিন কথা হবে। ভালো থাকবেন, আল্লাহ হাফেজ।
একটু আগে যার সাথে কথা বললাম সে আমাদের কলেজের সিনিয়র বড় ভাই। নাম সিফাত৷ বিরাট বড়লোকের ছেলে। বেশ কিছুদিন ধরে সে আমার পিছনে আটার মতো লেগে আছে৷ অনেক বার আমাকে ভালোবাসার কথা জানিয়েছে কিন্তু আমি এইসব কথায় পাত্তা দেই নি।
আর কলেজে আসার সময় রাস্তায় যার সাথে কথা হলো সে আমাদের পারার ছেলে নাম রিফাত। মধ্যবিত্ত পরিবারের সন্তান। পড়াশোনা তেমন করে নি। তার বাবার মৃত্যুর পর এখন সে তার বাবার ছোটখাটো একটা দোকানের দায়িত্বে আছে। ছোটবেলা থেকেই লক্ষ্য করছি সে আমাকে অন্য দৃষ্টিতে দেখে। তবুও এটা বোঝার পরও না বোঝার ভান ধরে থাকতাম। এবার ভাবছি রিফাত আর সিফাত এই দুজন থেকে যেকোনো একজনকে আমার জীবনে বেছে নেবো। যে আমাকে সত্যিকারের ভালোবাসবে তাকেই আমার মনের সিংহাসনে বসাবো।
পড়ন্ত বিকেলে উষ্ণ বাতাস গায়ে লাগিয়ে নদীর পাড়ে আমরা তিনজন দাঁড়িয়ে আছি৷ সূর্য ডোবার দৃশ্যটা খুব মনোযোগ সহকারে দেখছি। এই সূর্যমামা সারাদিন এত তেজ দেখায় যা বলার মতো না। কাঠফাটা রোদে পুড়িয়ে মারে। অথচ বিদায়ের বেলায় কত নীরব আর কত শান্ত। নিজের অলৌকিক ক্ষমতা দিয়ে সবার দৃষ্টি সে নিজের দিকে আকৃষ্ট করে নিয়েছে। সারাদিন আগুনের উত্তাপে নিজেকে পুড়িয়ে অন্যকে আলোকিত করাতেই তার জীবনের স্বার্থকতা। পৃথিবীর প্রতি তার ভালোবাসার কোনো শেষ নেই। ভালোবাসা বোধহয় এমনি হয়।
আচ্ছা রিফাত আর সিফাত এই দুজনের মধ্যে কে আমাকে সূর্যের মতো নিজেকে পুড়িয়ে ভালোবাসতে পারবে? কে পারবে আমাকে যথাযথ মর্যাদা দিয়ে সারাজীবন ভালোবাসতে? যাইহোক, একটি পরীক্ষা করে দেখি কার দৌড় কতদূর।
রিফাত, সিফাত তোমরা দু’জনকে আজকে এখানে একসাথে ডেকেছি একটি বিশেষ কারণে। আমি জানি তোমরা দুজন আমাকে ভালোবাসো। কিন্তু আমার একার পক্ষে তোমাদের দু’জনকে ভালোবাসা সম্ভব না এটা তোমরা ভালো করে জানো। শুধু তোমরা নও তোমাদের মতো আরো অনেকে আমাকে ভালবাসে। আমার হয়তো স্বপ্ন দেখার মানুষ নাই কিন্তু আমাকে নিয়ে স্বপ্ন দেখার মানুষের অভাব নাই। থাক আজকে সেই সব কথা।
আমি তোমাদের মধ্যে তাকেই আমার জীবনে বেছে নিবো যে আমাকে গোলাপ ফুলের পরিবর্তে ১০৮ টি নীলপদ্ম দিয়ে প্রথমে  প্রপোজ করবে। আমি জানি আমাদের আশেপাশে কোনো পদ্ম পুকুর নেই যেখান থেকে তোমরা এই ফুলটি খুব সহজে সংগ্রহ করতে পারবে। তবুও আমার ভালোবাসার প্রথম বাহক হিসেবে আমি পদ্মফুল চাই এবং গুনে গুনে ১০৮ টি। মূলত লাল, সাদা এবং গোলাপীর মিশ্রণ যুক্ত ১০৮টি পদ্মফুল হলেই আমার চলবে। আমি তোমাদেরকে ১০ দিন সময় দিলাম। এই ১০ দিনের ভিতরে তোমরা প্রমাণ করো যে কে আমাকে কতটুকু ভালোবাসো। কথা দিচ্ছি, যার ভালোবাসা খাঁটি হবে তাকেই আমি আমার জীবনসঙ্গী করে নিবো।
রিয়ার কথা শেষে সিফাত বললো, এই সামান্য ১০৮টি পদ্মফুল লাগবে তোমার! এটা কোনো ব্যপার হলো?  আমি ১ দিনের মধ্যে তোমাকে ১০৮টি কেন ১০০০ টি পদ্মফুল এনে দিতে পারবো এবং এই মুহূর্তে এখানে দাঁড়িয়ে।
অন্যদিকে রিফাত কিছু না বলে চুপচাপ দাঁড়িয়ে তাদের কথা শুনছে।
রিয়া বললো, আমাকে ১ দিনে এনে দিতে হবে না আমি ১০ দিন সময় দিলাম৷ তোমরা চেষ্টা করো। তারপর তিনজন যে যার মতো গন্তব্যের দিকে চলে গেল।
বাসায় এসে রিয়া ভাবছে এই প্রতিযোগিতায় কে বিজয়ী হবে? আচ্ছা দুজনের মধ্যে তো একজন জয়ী হবে আর অন্যজন পরাজিত হবে। সেই মূহুর্তে দুজনের অনুভূতি কেমন হবে? একজনের মুখে থাকবে প্রিয়জনকে সারাজীবন কাছে পাওয়ার আনন্দ মাখা হাসি আর অন্য জনের মুখে থাকবে না পাওয়ার বেদনার চাপা কান্না। তাতে কি! সব ভালোবাসার তো মিলন হয় না। বাস্তবতা মেনে নেওয়াই তো মানবজাতির ধর্ম। জগতে বাস করতে হলে জয় পরাজয় হতেই পারে এটা অস্বাভাবিক কিছু না। তবুও হৃদয়ে রয়ে যায় কিছু অস্পষ্ট ক্ষত। যা কেউ কোনোদিন দেখে নি আর দেখতেও পারবে না।
আজ ১০ দিনের দেওয়া তৃতীয় দিন চলছে। সিফাত তার বাসার কাজের ছেলেটিকে দিয়ে ২ দিনের ভিতর ১০৮ টি পদ্মফুল জোগাড় করে ফেলছে। বাসায় এনে সেগুলো খুব যত্ন সহকারে ফ্রিজের ভিতরে রেখে দিয়েছে যাতে ফুলগুলো সতেজ থাকে। সিফাতের বুদ্ধির তারিফ করতে হয়৷ কোনো কষ্ট ব্যতীত সে প্রতিযোগিতায় বিজয়ী হবে ভাবতেই কেমন মনের ভিতর আনন্দের জোয়ার বইছে। কিন্তু কাজের ছেলেটায় যে কত কষ্ট করে সেগুলো সংগ্রহ করেছে সেটা হয়তো সিফাতের অজানাই রয়ে যাবে। বড়লোকদের এসব ছোটখাটো বিষয় জানতে হয় না, এসব জানার প্রয়োজনও হয় না তাদের । সিফাত এখন বসে বসে ১০ দিনের শেষ দিন কবে হতে যাচ্ছে সেই দিন গুনছে।তার কাছে  ১ সেকেন্ড মনে হচ্ছে এক ঘন্টার সমান। সময় যেন কিছুতেই কাটতে চাইছে না। সত্যি অপেক্ষার প্রহর অনেক কষ্টের।
অন্যদিকে রিফাত হন্য হয়ে নীলপদ্ম খুঁজছে। শহরে কোথাও খুঁজে না পেয়ে গ্রামে এসেছে পদ্মফুল খুঁজতে। গ্রামে তার এক খালা থাকেন। যদিও গ্রামাঞ্চলে এই ফুলের বাহার রয়েছে তবুও খুঁজে না পাওয়া অব্ধি  কখনো নিশ্চিত হওয়া যায় না। এদিকে রিয়ার দেওয়া সময় ঘনিয়ে আসছে। আচ্ছা সময় এতো তাড়াতাড়ি চলে যাচ্ছে কেন? একটু দেরিতে গেলে কি এমন ক্ষতি হতো? খালাতো ভাইকে সঙ্গে নিয়ে সে ফুলটি খুঁজতে নেমেছে। যাও একটি পুকুরে পদ্মফুল পাওয়া গেল কিন্তু ১০৮ টি তো দূরের কথা ২০ টি ও হবে কি না সন্দেহ। রিফাত চিন্তায় পড়ে গেল। তাহলে কি রিয়ার দেওয়া শর্ত পূরণ করতে সে ব্যর্থ হয়ে যাবে? কিন্তু তার ভালোবাসা তো খাঁটি। সত্যিকারের ভালোবাসা এভাবে পরাজিত হতে পারে না।
অবশেষে ৯ দিনের মাথায় এসে রিফাত ১০৮ টি নীলপদ্ম জোগাড় করে ফেললো। এই কয়টা দিন সে রাতে শান্তিমত ঘুমাতে পারে নি৷ এত টেনশন মাথায় নিয়ে কেউ কি কখনো শান্তিমত ঘুমাতে পারে? ঘুমানোর জন্য চাই মনের প্রশান্তি। অনেক দিন পর আজ রিফাত মনে কিছু শান্তি পাচ্ছে। হৃদয়ে স্বস্তি অনুভব হচ্ছে। কাল সকাল হলেই প্রিয় মানুষটির প্রিয় ফুল নিয়ে সে হাজির হবে। অনেক দিন পর নিশ্চিন্তে আজ তার চোখের দরজা দুটো এক হলো।
সকালের দৃশ্যটা দেখার জন্য কেউই প্রস্তুত ছিল না বিশেষ করে রিফাত। সময় খারাপ হলে যায় হয় আর কি। রিফাতে খালাতো ভাই সোহেলের শখের ছাগলটায় রিফাতে ভালোবাসার ১০৮টি পদ্মফুল পেটে হজম করে ফেলছে। এই পরিস্থিতি দেখে হাসবে না কাঁদবে সেটা রিফাত বুঝতে পারছে না। তার মনটা বিষন্ন হয়ে গেল। এই বিষন্ন মন নিয়ে গুটি গুটি পায়ে সে ঢাকার উদ্দেশ্যে রওয়ানা দিল।
আজকে রিয়ার দেওয়া ১০ দিন শেষ। কথা ছিল আজ বিকালে ফুলগুলো নিয়ে রিয়ার সামনে হাজির হবে৷ কিন্তু সে এমন একজন প্রেমিক যাকে সামান্য একটি ছাগল পরাজয় করাতে মূখ্য ভূমিকা পালন করলো। ছাগল বাবাজি এই কাজটা না করলেও পারত। বাস থেকে নেমে রিফাত হাঁটা শুরু করলো নদীর পাড়ের দিকে। আজ সেখানে রিয়ার সাথে তাদের দুজনের দেখা করার কথা। কিন্তু খালি হাতে কিভাবে রিয়ার সামনে যাবে। এই ভেবে রিফাত কদম গাছ থেকে সাদা আর হলুদ রঙের সংমিশ্রণের ১০৮টি কদম ফুল পেরে রিয়ার সামনে হাজির হলো। অন্যদিকে সিফাত রিয়ার পছন্দের ১০৮টি পদ্মফুল নিয়ে যথা সময়ে উপস্থিত হলো। ইতিমধ্যে রিয়াও চলে এসেছে।
সিফাত ১০৮ টি নীলপদ্ম রিয়ার দিকে এগিয়ে দিয়ে বললো, এই নাও তোমার ১০৮ টি নীলপদ্ম। এগুলো গ্রহণ করে আমাকে ধন্য করো মহারাণী।
রিয়া বললো,
-আশ্চর্য! তুমি আমাকে মহারাণী বলছো কেন?
-আমি তোমাকে মহারাণী বলবো নাতো কে বলবে শুনি? আমি তো তোমার দেওয়া শর্ত পূরণ করলাম। প্রতিযোগিতায় বিজয়ী আমি। এখন আমিই তোমার ভালোবাসার মানুষ। তোমার মনের সিংহাসনের রাজা।
সিফাতকে থামিয়ে রিয়া বলতে লাগলো
-বেশি কথা আমি পছন্দ করি না৷ তুমি নীলপদ্ম এনেছ কিন্তু আরেকজন রয়েছে এবার দেখি সে এই ১০ দিনে কি করলো। তারপর না হয় নিজেকে বিজয়ী ঘোষণা দিবে।
-রিফাত তোমার নীলপদ্ম কোথায়?
রিফাত চুপ করে আছে। তারপর সে ১০৮টি কদমফুল এগিয়ে দিয়ে বললো
-এই নাও তোমার আনকমন প্রপোজালের ফুল। রিয়া আমি তোমাকে ভালোবাসি। আমি তোমার প্রেমিক হতে চাই না,  আমি চাই তোমার সারাজীবনের সুখ দুখের সঙ্গী হতে। প্রেমিকরা অনেক সময় নিজের স্বার্থের জন্য প্রেমিকার হাত ছেড়ে দেয় কিন্তু আমি তোমাকে এমন বন্ধনে আটকাতে চাই যেখান থেকে কেবল মৃত্যু পারবে আমাকে তোমার থেকে আলাদা করতে। আমি তোমাকে প্রেমিকা নয় বউ বানাতে চাই। তুমি কি আমার বউ হবে রিয়া? আমার রাজ্যের রাণী হবে?
রিফাতের কথা রিয়া শুনছে আর মনে মনে ভাবছে সারাজীবন কি আমি এটাই চেয়েছিলাম?  সে সবসময় চেয়েছে এমন কিছু চাওয়া-পাওয়া  যা আগে কখনো ঘটেনি কিংবা হয় নি। তার সবসময় আনকমন জিনিসগুলাই পছন্দ। এখন এই মূহুর্তে দাঁড়িয়ে মনে হচ্ছে পৃথিবীর শ্রেষ্ঠতম আনকমন পারসন কি এখন তার সামনে দাঁড়িয়ে আছে?
সিফাত এই দৃশ্য দেখে রীতিমতো রেগেমেগে আগুন হয়ে যাচ্ছে । রিয়াকে উদ্দেশ্য করে সে বলছে এখানে কোন সিনেমার শুটিং হচ্ছে জানতে পারি?  কথা ছিল কি আর এখানে হচ্ছেটা কি? এসবের মানে কি রিয়া?
রিয়া এবার দুজনের উদ্দেশ্য বললো, এবার আমি কি বলছি তোমরা মনোযোগ দিয়ে শুন।
তোমার কি ভেবেছিলে তোমাদের দু’জনকে আমি একটি দায়িত্ব দিবো আর আমি কোনো খুঁজ খবর রাখবো না? তোমরা কে কিভাবে নীলপদ্ম আর কদমফুল জোগাড় করেছো সব তথ্য আমার কাছে আছে। আর সিফাত তুমি কিসের জোড়ে এতো লাফালাফি করছো? ১০৮ টি নীলপদ্ম তো দূরের কথা একটি কদমফুল আনতে পেরেছো নিজের যোগ্যতায়? আমাকে খুশি করার জন্য যে ১০৮ টি নীলপদ্ম আনলে তুমি কি বলতে পারবে এগুলো কোথায় থেকে আনা হয়েছে? কিসের জোড়ে তুমি প্রতিযোগিতায় নেমেছ বলতে পারো? আজ যদি তোমার জায়গায় তোমার কাজের ছেলেটা থাকত “যে ১০৮ টি নীলপদ্ম জোগাড় করেছে তোমাকে বিজয়ী করার জন্য ”  তাহলে হয়তো আমি তাকেই জীবনে বেঁচে নিতাম। কিন্তু তুমি কোন মুখে এসে আমার সামনে দাঁড়িয়ে এত বড় বড় কথা বলছো? টাকার গরমে? নাকি মিথ্যা আভিজাত্যর অহংকারে।
রিয়ার কথা শুনে সিফাত লজ্জায় মাথা নিচু করে দাঁড়িয়ে আছে। তার আর কিছু বলার নাই।
রিফাত আমি তোমার প্রপোজাল গ্রহণ করলাম। আমি তোমার প্রেমিকা নই বউ হতে চাই। বানাবে না আমাকে তোমার হলুদ ফুলের রাণী?
রিফাত রিয়ার হাত শক্ত করে ধরে বললো মৃত্যুর আগ পর্যন্ত এই হাত কোনোদিনও ছাড়বো না কথা দিলাম। তোমাকে নিয়ে আমি আমার উদ্দেশহীন পথে সারাজীবন হাঁটতে চাই। অজানা পথ তোমাকে নিয়ে পাড়ি দিতে চাই। আমার নিঃসঙ্গ দিনগুলোর আকন্ঠ সঙ্গী হিসেবে শুধু তোমাকেই চাই.!!
লেখিকা: শিক্ষার্থী, সুনামগঞ্জ সরকারি মহিলা কলেজ।    

শেয়ার করুন




 

 

 

 

© 2017-2022 All Rights Reserved Amadersunamganj.com
Design & Developed BY ThemesBazar.Com
error: Content is protected !!