মঙ্গলবার, ২৬ জানুয়ারী ২০২১, ১১:১৭ অপরাহ্ন
স্বাধীন বাংলাদেশের স্থপতি বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানের ১৯৭১ সালের ৭ই মার্চের ভাষণটি বিশ্বব্যাপী আলোড়ন সৃষ্টিকারী একটি আর্ন্তজাতিক স্বীকৃত ভাষণ। ২০১৭ সালের অক্টোবরের শেষে ইউনেস্কো ৭ই মার্চের ভাষণটিকে ‘ডকুমেন্টারী হেরিটেজ’ (বিশ্ব প্রামাণ্য ঐতিহ্য ) হিসেবে স্বীকৃতি দেয়। বঙ্গবন্ধুর এই ভাষণটির মাধ্যমে দেশবাসী স্বাধীনতার মন্ত্রে উজ্জীবিত হয়ে যুদ্ধে ঝাঁপিয়ে পরে । দেশবাসীর ঐক্যবদ্য সংগ্রামে মাত্র নয় মাসে দেশটি স্বাধীনতা অর্জন করে। এই স্বাধীনতা অর্জনে বঙ্গবন্ধুর ৭ই মার্চের ভাষণটি বড় ধরনের একটি প্রভাব বিস্তার করে। একজন রাষ্ট্রনায়কের আটারো মিনিটের অলিখিত কালজয়ী একটি ভাষণ জাতিকে স্বাধীনতা এনে দেয়। কেমন ছিলো এই ভাষণ। কি কথা ছিলো এই ভাষণে। আমাদের বর্তমান তরুণ প্রজন্মের এটা জানা উচিত। গবেষকদের দ্বারা ঐতিহাসিক এই ভাষণটি চুলচেরা বিশ্লেষন হচ্ছে। কি অসাধারণ কাব্যিক কথামালা। জাতির মহা নায়ক, রাজনীতির কবি, হাজার বছরের শ্রেষ্ট বাঙ্গালী শেখ মুজিবুর রহমানের ৭ মার্চের ভাষণে ছিলো এক সম্মোহনী শক্তি। ভাষণটি শুনলে আজও বাঙ্গালী দেশপ্রেমে উজ্জীবিত হয়। এই ভাষণ দ্বারা তিনি দেশবাসীকে পাকিস্থানী শাসকদের কাছে থেকে স্বাধীনতা ছিনিয়ে আনতে উদ্ধুদ্ধ করেছিলেন । তাঁর ভাষণে তেজস্বী কন্ঠ, অকুতভয় ও সাহসী উচ্চারণ, মঞ্চে দাঁড়ানোর ভঙ্গী, ভাষণের সাথে সাথে অঙ্গুলী প্রদর্শন ভাষণটিকে অসাধারণ করে তুলে। দেশের স্বাধীনতার ডাক দিতে এমন একটি ভাষণের প্রয়োজন পূর্বেই তিনি অনুভব করেছিলেন। ধীরে ধীরে স্বাধীনতা ডাক দিতে ভাষণের প্রস্তুতি নিচ্ছিলেন। ভাষণের প্রেক্ষাপট তৈরী হয় বেশ কিছু দিন পূর্বেই। ১৯৭০ সালে সাধারণ নির্বাচনে সংখ্যাগরিষ্ট আসনে জয়ী হয়েও বঙ্গবন্ধুর রাজনৈতিক দল আওয়ামীলীগ সরকার গঠন করতে পারে নি। ক্ষমতা হস্তান্তর করতে পাকিস্থানী শাসকদের চলে নানাবিধ টালবাহানা। বাঙ্গালী বুঝতে পারে পাকিস্থানী শোষক, অত্যাচারী শাসকদের নীল নকশা। তারা কখনই ক্ষমতা হস্তান্তর করবে না। তখন থেকেই স্বাধীনচেতা বীর বাঙ্গালীর স্বাধীনতার সংগ্রাম আরো বেগবান হয়। মার্চের প্রথম থেকেই দেশ উত্তাল। এরই মধ্যে দেশে স্বাধীন বাংলাদেশের পতাকা খচিত মানচিত্র উত্তোলন করা হয়েছে। পাঠ করা হয়েছে স্বাধীনতার ইশতেহার। নির্বাচন করা হয়েছে জাতীয় সঙ্গীত। স্বাধীনতা আন্দোলনের মহান নেতা শেখ মুজিবুর রহমান স্বাধীনতার প্রশ্নে বা আন্দোলনের ব্যাপারে চূড়ান্ত কোন সিদ্ধান্ত কবে দিবেন দেশবাসী সেই অধীর অপেক্ষায় ছিলো। স্বাধীনতার ডাক দিতে এবং দেশবাসীকে স্বাধীনতার সংগ্রামে ঝাঁপিয়ে পরতে প্রয়োজন ছিলো একটি কালজয়ী ভাষণ। ৭ই মার্চ সকাল থেকেই ঢাকায় বঙ্গবন্ধুর ধানমন্ডীর ৩২ নম্বর বাড়িটি ছিলো লোকে লোকারণ্য। আজ শেখ মুজিব জাতির উদ্দেশ্যে ভাষণ দিবেন। তাই বাড়িটি ছিলো আওয়ামীলীগের শীর্ষ নেতা এবং ছাত্র নেতাদের ভিড়। অনেক নেতা কর্মী ভাষণে বলার জন্যে তাঁদের মতামত সম্বলিত স্লীপ বঙ্গবন্ধুর হাতে ধরিয়ে দিচ্ছেন। দুপুর দুটার দিকে আব্দুর রাজ্জাক ও তোফায়েল আহমেদসহ তরুণ নেতাকর্মীদের সাথে নিয়ে শেখ মুজিবুর রহমান তাঁর বাড়ি থেকে রওয়ানা হন জনসভার উদ্দেশ্যে। ভাষণ দিতে বাসা থেকে বের হবার সময় শেখ মুজিবুর রহমানকে তাঁর স্ত্রী শেখ ফজিলাতুন্নেসা মুজিব বলেছিলেন “লোকে যে যাই বলুক বা পরামর্শ দিক, তুমি জাতির নেতা তোমার মনে যাই আসে, তুমি যা বিশ^াস করো ভাষণে তাই বলবে।” রেসকোর্স ময়দানে ( বর্তমানে সোহরাওয়ার্দী উদ্যান) ১৯৭১ সালের ৭ই মার্চের ভাষণটি শুরু হয় দুপুর ২.৪৫ মিনিটে শেষ হয় ৩.০৩ মিনিটে। এই আটারো মিনিটে জাতির পিতা বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান তাৎক্ষনিক ভাষণে গুরুত্বপূর্ণ কিছু বিষয় তুলে ধরেন। এই মহান নেতা তাঁর ঐতিহাসিক ভাষণে তুলে ধরেন পূর্ব ও পশ্চিম পাকিস্থানের সামগ্রিক পরিস্থিতি। পশ্চিম পাকিস্থানের রাজনীতিবিদদের ভুমিকা ও আন্দোলন, সামরিক আইন প্রত্যাহারের দাবি, অত্যাচার ও সামরিক আগ্রাসন মোকাবেলায় বাঙ্গালীদের আহবান জানানো, দাবি আদায় না হওয়া পর্যন্ত পূর্ব পাকিস্থানে হরতাল চালিয়ে যাওয়া, নিগ্রহ ও আক্রমন প্রতিরোধে আহবান এবং বাঙ্গালীকে স্বাধীনতার মন্ত্রে উজ্জীবিত করা। ভাষণে তাঁর বজ্রকন্ঠে উচ্চারণ ‘এবারের সংগ্রাম আমাদের মুক্তির সংগ্রাম, এবারের সংগ্রাম আমাদের স্বাধীনতার সংগ্রাম’ বাঙ্গালী জাতিকে জীবন বাজি রেখে স্বাধীনতার লাল সূর্য ছিনিয়ে আনতে সহায়তা করেছিল। পাকিস্থান সরকার ৭ই মার্চের ভাষণটি রেডিও ও টেলিভিশনে প্রচার করার অনুমতি দেয়নি। এই ভাষণটি দেশের শিক্ষা কারিকুলামে বর্তমানে একাদশ শ্রেণির ইংরেজি পাঠ্যবইয়ে অর্ন্তভুক্ত করা হয়েছে। যখন ভাষণটি শ্রেণি কক্ষে শিক্ষার্থীদের সামনে উপস্থাপন করি তখন চোখ বন্ধ করলে কল্পনায় সামনে দেখতে পাই বঙ্গবন্ধুর সেই ভাষণটি। সেই ভরাট কন্ঠ। সাহসী উচ্চারণ। আমরা যারা স্বাধীনতা উত্তর প্রজন্মের সন্তান তারা বঙ্গবন্ধুর সেই ভাষণটি শুনে বার বার দেশ প্রেমে উজ্জীবিত হই। নতুন প্রজন্মের কাছে বঙ্গবন্ধুর সেই ভাষণটি যথাযথ ভাবে তুলে ধরতে হবে। তাহলে তারা দেশ প্রেমে উজ্জীবিত হয়ে নিজের জীবনকে উপযুক্তভাবে গড়ে তুলবে। কর্ম জীবনে দেশ সেবায় নিয়োজিত হবে। আজ বঙ্গবন্ধু আমাদের মাঝে নেই। তাঁর কালজয়ী ভাষণটি আমাদেরকে তাঁর স্বপ্নের সোনার বাংলা গড়ার জন্যে আমাদেরকে যুগের পর যুগ, শতাব্দির পর শতাব্দির প্রেরণা যোগাবে।
লেখক: প্রভাষক, ইংরেজি বিভাগ, সরকারি দিগেন্দ্র বর্মন কলেজ, বিশ্বম্ভরপুর, সুনামগঞ্জ।