মঙ্গলবার, ২৬ জানুয়ারী ২০২১, ১১:৫৬ অপরাহ্ন
আমার নানার বাড়ি সুনামগঞ্জ জেলার তাহিরপুর উপজেলার দক্ষিন শ্রীপুর ইউনিয়নের সুলেমানপুর গ্রামে। গ্রামটি আশে পাশে শনির হাওর, টাঙ্গুয়ার হাওর, মাটিয়ান হাওর ও মল্লিয়ার হাওরের অবস্থান। বর্ষায় চর্তুদিকে পানি আর পানি। পানিতে ভেসে থাকা গাছ গাছালি দিয়ে ঘেরা দ্বীপ সদৃস একটি গ্রাম। হেমন্তে সবুজ ধানের শীষে আচ্ছাদিত বিস্তীর্ণ জমি। প্রকৃতির অপরুপ রুপে ঘেরা এই নানা বাড়ি। নানা হাজি সফর আলী গত হয়েছেন প্রায় তিন যুগ পূর্বে। তার পর নানুই নানা নানীর ভুমিকায় ছিলেন অনেক দিন। তিনিও চলে যান ২০১৬ সালের ২২ আগষ্ট দুজনের গড়া সাজানো সংসার রেখে। জীবনের কঠোর বাস্তবতায় সেদিন নানুকে গিয়ে শেষ বিদায় জানাতে পারিনি। আমার নানা বাড়ির স্মৃতির পাতায় ভেসে উঠে হাওরাঞ্চলের মানুষের জীবনচিত্র। নানু নানার দ্বিতীয় স্ত্রী। ১ম স্ত্রী এক ছেলে ও এক মেয়ে রেখে মারা যান। পরে নানা তাঁর কম বয়সী শ্যালিকাকে বিয়ে করে সংসারে নিয়ে আসেন। তারপর আমার মায়ের জন্ম হয়। সংসার বড় হতে থাকে। পরে একে একে তাদের সংসারে জন্ম নেয় আরো দশ জন সন্তান। দশ জন মেয়ে সন্তান জন্মের পরে তাদের সখ হল ছেলে সন্তানের। আল্লাহ সে আশাও অপূর্ণ রাখেন নি। জন্ম হয় ছেলে সন্তানের। নানুর সর্ব কনিষ্ঠ সন্তান আমার মামাও আমার চেয়ে কয়েক বছরের বড়। নানু ছোট মামার সংসারেই থাকতেন । নানা গত হবার পর নানুর হাতে সংসারে দায়িত্ব পরে। নানু শক্ত হাতে সংসার আগলে রেখেছেন। নানা জমিতে পেতেন হাজার মন ধান, বাড়িতে সার্বক্ষনিক থাকত কাজের লোক, ঘাটে বাধা বড় নৌকা, দোতলা বাড়ি, নিরাপত্তায় বন্দুক। কালের পরিক্রমায় আজ অনেক কিছুই নেই। আছে এসবের স্মৃতি চিহ্ন। নানা বছরে দুবার তার মেয়েদেরকে নাইওর আনতেন। নানা পরপারে চলে যাবার পর নানুও সেটা অব্যাহত রেখেছিলেন। তিনিও বর্ষায় ও হেমন্তে সব মেয়েকে জামাই সহ নাওর আনতেন। সবাই মিলে নানুকে নিয়ে দিনে রাতে আড্ডা জমে উঠত। সে কি ভুলা যায়। নাওর শেষে বিদায় বেলায় হৃদয়ে বেজে উঠত সানাইয়ের করুণ সুর। চোখ মুছতে মুছতে নৌকা দিয়ে বাড়ি চলে আসতাম। পেছনে পড়ে থাকত সমবয়সী ভাই বোনদের সাথে দুষ্টুমী, মারামারি। খালারা আমাদের ঝগড়া মেটাতে ব্যস্থ থাকতেন। নানুর নাতী-নাতনীর সংখ্যা অর্ধ শতাধিকের উপরে। জীবনের কঠোর বাস্তবতায় তারা দেশে বিদেশে অবস্থান করছে। বর্ষায় নাওরে গেলে ভাই বোনদের সাথে নাওয়া খাওয়া বাদ দিয়ে আড্ডায় মেতে উঠতাম। প্রতি বর্ষায়ই এ মিলন মেলা হত। আমার বাবা মা ঘরে তালা লাগিয়ে অনেক দিনের জন্যে নানা বাড়িতে নাওরে গিয়েএ মিলন মেলায় যোগ দিতেন। কোন সময় এক সপ্তাহ, কোন সময় পক্ষকাল ব্যাপী। এক বছর পুরো পনের দিন নানা বাড়িতে নাওরে ছিলাম। এক নাগারে অনেকদিন বৃষ্টি ছিল। স্কুল কামাই করায় স্যারদের বকুনি খেয়েছি। নানা মারা যাবার পরও নানুর দাপুটের কমতি ছিল না। নানু গ্রামের মাতব্বরের ভুমিকায় ছিলেন। গ্রামে কোন সমস্য দেখা দিলে সবাই নানুর কাছে হাজির। সমাধান করে দিতেন। মানুষকে আর্থিক ভাবে সহযোগিতা করতেন। নানুর শারীরিক কাঠামোও সে রকম ছিল। ছিল ভরাট কন্ঠস্বর। আমরা মাঝে মাঝে দুষ্টুমী করে সামন থেকে চলে যেতাম। বাড়ির সামনে একটি বড় পেয়ারা গাছ ছিল। গাছে উঠে পেয়ারা খেতাম। নানু দেখলেই বলতেন “শীঘ্রই নেমে আয়, পরে হাত পা ভাঙ্গবে”। যতদিন নানু বেচেঁ ছিলেন নানুর মেয়েরা, নাতী, নাতনী সবাই নিয়মিত নানুর খোঁজ খবর নিয়েছেন। চিকিৎসার ব্যবস্থা করছেন। সময়ের পরিবর্তনে আজ অনেক দিন নানা বাড়িতে যাওয়া হয় না। কিন্তু নানা বাড়িতে নাইওর যাবার স্মৃতিগুলো এখনও স্পষ্ট। সেই নানা বাড়ি আছে কিন্তু সেই খালাত ভাই বোনদের শোরগুল আর নেই। সবাই যে যার মতো নিজের সংসারে ব্যস্ত সময় পার করছে।
লেখকঃ প্রভাষক, সরকারি দিগেন্দ্র বর্মন কলেজ, বিশ্বম্ভরপুর, সুনামগঞ্জ।