মঙ্গলবার, ২১ মার্চ ২০২৩, ০৪:০৬ পূর্বাহ্ন

জাকির হোসেন রাজু’র ধারাবাহিক উপন্যাস “যুদ্ধ শিশু” (২য় পর্ব)

জাকির হোসেন রাজু’র ধারাবাহিক উপন্যাস “যুদ্ধ শিশু” (২য় পর্ব)

পূর্ব প্রকাশের পর……

রহিমের মা সবজি নিয়ে রান্না ঘরে চলে গেল। সন্ধ্যা ঘনিয়ে এলো, ঘরের কোনে বাসা করা চড়–ই পাখি গুলো কিচির মিচির শব্দ করতে লাগল। মসজিদ থেকে মাগরিবের আযানের ধ্বনি শোন গেল। রহিমের মাকে ফাহিমা খাতুন বলল এই রহিমের মা রান্না পরে করবিনে, আগে নামাজ পড়ে লও। রহিমের মা সবজি আর কাটা শেষ করতে পারেনি, অর্ধেক রেখেই চলে গেল ওজু করার জন্য। ততক্ষণে ইমনও শিমুলদের বাড়ি পৌছে গেছে। এই শিমুল…শিমুল বাড়িতে আছিস নি? বলে ডাক দিলো ইমন। শিমুল তার রুম থেকে বের হয়ে অবাক হয়ে বলল আরে ইমন তুই, তাও আবার এই সন্ধ্যায় কিজন্য আসলি? কেন আমার কি তোদের বাড়িতে সন্ধ্যায় আসা বারন আছে নাকি? আরে না তা বলছি না, অনেকদিন পরে আসলি তো তাই। তো ঘরে চল্। ইমন শিমুলে পেচনে পেচনে ঘরে চলে গেল। ঘরে ঢুকে ইমন রীতিমত অবাক। শিমুলের পড়ার ঘরে মেয়ে। ঘরে দুটি চেয়ার রাখা এককটিতে মেয়েটি বসে কি যেন লিখছে, আরেকটি চেয়ার ফাঁকা। শিমুল ইমনকে লক্ষ করে বলল কিরে তুই বসবি না দাঁড়িয়ে থাকবি? সাথে সাথে ইমন পালঙ্কে গিয়ে বসল। শিমুলও ইমনের সাথে পালঙ্কে বসে পড়ল। এবার কি জন্য আসলি এই সন্ধ্যায় এতো রাস্তা হেঁঠে? আসলাম আজ কলেজে যাইনি, সামনে তো পরীক্ষা, নিয়মিত ক্লাসের পড়া শেষ না করতে পারলে সমস্যায় পড়ে যাবো তাই তোর কাছ থেকে আজকের পড়া গুলো জানতে আসলাম। আরে দুস্ত আমি তো আজকে কলেজে যাইনি। কি বলিস, তাহলে তো আমি আর আজকের পড়া জানতে পারবো না বলে চিচিন্ত হলো ইমন। আরে সমস্যা নেই জানতে পারবি এক কাজ কর তুই বৃষ্টির কাছ থেকে জেনে নে বলল শিমুল। বৃষ্টি আবার কে বল? ও তোকে তো পরিচয় করিয়ে দেইনি বৃষ্টিকে দেখিয়ে বলল ও হচ্ছে আমার ছোট বোন বৃষ্টি। আমাদের সাথেই পড়ে। এতো দিন শান্তিপুর মামার বাড়িতে থাকতো। সেখান থেকেই এসএসসি পাস করেছে। ও আজই কলেজে প্রথম গিয়েছিল। বৃষ্টি ও হচ্ছে আমাদের কলেজের সবছেয়ে ট্যালেন্ট ছাত্র। এসএসসিতে জিপিএ-৫ পেয়েছে। আমার হাইস্কুল জীবনের বন্ধু। ভালো আছেন ইমনকে উদ্দেশ্য বলল বৃষ্টি। হ্যা ভালো। এই নিন বলে হাত বাড়িয়ে দিয়ে ইমনকে খাতা দিল বৃষ্টি এবং বলল এই খাতায় আজকের পড়া সব নোট করা আছে আপনি নিয়ে যেতে পারেন। তবে কাল আমাকে কলেজে দিয়ে দিয়েন।ু ঠিক আছে কালকে আমি আপনাকে কলেজে দিয়ে দেব। ধন্যবাদ আপনি আমাকে বাঁচালেন। কেন, খাতা না পেলে কি মরে যেতেন? তা না, তবে কি? তবে মায়ের সামনে কি নিয়ে দাঁড়াবো তা নিয়ে খুব টেনশন হচ্ছিল। ঠিক আছে কাল আপনার সাথে ক্যাম্পাসে দেখা হবে আপনার খাতা নিয়ে। এই শিমুল আমি চললাম। শিমুল বলল চল্ তোকে এগিয়ে দিয়ে আসি বলে ঘর থেকে বের হলো। হাঁটতে হাঁটতে শিমুল বলল এবার বল ইমন তোর লেখা পড়ার খবর কি? তেমন ভালো নারে দোস্ত। কেন কোন মেয়ের প্রেমে টেমে পড়লি নাকি? আরে না তাহলে হলে তো তুই জানবেই। কিভাবে জানবো বলতো তোর সাথে আমার কতো দিন পর দেখা হয়েছে? কলেজেও দেখা করিস না। অনেকদিন পর দেখা হয়েছে তা ঠিক। তবে আমিই তো অবশেষে তোর বাড়ি এসে দেখা করলাম, তুই তো কোনদিন গেলি না আমাদের বাড়িতে। সময় পাইনারে দোস্ত তুই তো দেখতেই পারছিস নিয়মিত কলেজে যেতে পারছিনা, বাবা তো তার চেয়াম্যানি আর জনগণের খেদমত নিয়ে ব্যস্ত। আমাকে বাবার ব্যবসা নিয়ে ব্যস্ত তাকতে হয়। যাবো নে তোর বিয়ের সময় দাওয়াত করলে। তুই কি যে বলিস দোস্ত আমার বিয়ে তোকে দাওয়াত করবো না তবে আর কাকে দাওয়াত করবো। ইমন তার হাতের ঘড়ির দিকে তাকিয়ে বলল ঠিক আছে দোস্ত ৭টা বেজে গেছে যেতে অনেক সময় লাগবে। ওকে কাল কলেজে গেলে দেখা হবে বলে চলে গেল শিমুল। ইমন র্নিজন মেঠে পথ ধরে ঝিঁ ঝিঁ পোকার আলোয় একা একা বাড়ির দিকে আসছে আর মনে মনে ভাবতে লাগল বৃষ্টির কথা। কতোই না ভদ্র একটি মেয়ে, এতো বড় লোকের মেয়ে কোন অহংকার নেই। যেই রূপ সেই গুণ। যেমন শিমুল ঠিক তেমনি তার বোনটি। ভালই হলো বৃষ্টির সাথে পরিচয় হয়ে। মাঝে মধ্যে সমস্যার কারণে কলেজে যেতে না পারলে অন্ততপক্ষে ক্লাসের পড়াটা তো জানার একজন মানুষ হলো। বৃষ্টির কথা ভাবতে ভাবতে কখন যে ১ ঘন্টার রাস্তা ইমন হেঁটে চলে আসল টেরই পেলনা। বাড়ির উঠোনে এসে দেখে ইমনের জন্য তার মা বারান্দায় বসে আছে। ইমন তার মাকে দেখে মনে মনে বলে আজকে ফেসে গেলাম। আমার মনে হয় রক্ষা নেই। আকাশের দিকে তাকিয়ে দুহাত উপরে তোলে মোনাজাত করল ইয়া আল্লাহ তুমি আমায় রক্ষা করো। ইমন মোনাজাত পড়ে শেষ করতে না করতেই ইমন….এই ইমন এদিকে আয় বলে কাছে ডাকল ইমনের মা। কি বল মা। কোথায় গিছেলি তুই? শিমুলদের বাড়িতে, হাতের খাতাটি দেখিয়ে বলে এই সাজেশন্সটি আনতে। ও আচ্ছা, তারাতারি হাত মুখ ধুয়ে খেতে আয়। আসছি বলে ঘরে চলে গেল ইমন। রহিমের কোথায় তুই? ইমন আসছে টেবিলে তারাতারি খাবার দে? আনছি আপা বলে রান্না ঘর থেকে জবাব দেয় রহিমের মা। ইমন তার রুমে প্রবেশ করে তাড়াহুড়ো করে জামাকাপড় পাল্টিয়ে টিউবওয়েল থেকে হাত মুখ ধুয়ে খাবার টেবিলে চলে এসে বসেছে। রহিমের সাথে তার মা ও বসেছে। রহিমের মা টেবিলে খাবার এনে দিল। চাচি তুমি এখন খাবে না? তুই খা রে বাবা আমি আরো পরে খাবো। রহিমের মা তুইও এখন খেয়ে নে বলল ফাহিমা খাতুন। আপা তোমরা খাও আমি পরে খাবো নে বলে পানির জগ হাতে নিয়ে টিউবওয়েলে চলে গেল রহিমের মা। ইমন তোর লেখা পড়ার খবর কি? ভালো মা। পরিক্ষা কবে? মাস খানেক পরে। দেখ বাবা তোকে আমি কতো কষ্ট করে লেখাপড়ার খরচ যোগাড় করে দেই, তুই যদি লেখাপড়ার প্রতি ভালোভাবে মন না দিস তাহলে আমার সারা জীবনে কষ্ট বিপলে যাবে। তুই ছাড়া আর জগতে কে আছে আমার। মা তুমি কোন চিন্তা করো না, তুমি শুধু আমার জন্য দোয়া করো দেখবা আমি এসএসসি পরীক্ষার মতো এইচ এসএসসি পরীক্ষায়ও জেলার মধ্যে প্রথম স্থান করবো। সেই দোয়াই করিরে বাবা। শুধু জেলার মধ্যে প্রথম হইলে হবে না রে বাবা, এবার তোকে সারা দেশের মাঝে প্রথম হতে হবে পানির জগ হাতে নিয়ে এস বলল রহিমের মা। চাচি তুমি আর মা শুধু আমার জন্য দোয়া করো পরীক্ষায় আমি অবশ্যই ভালো করবো। রহিমের মা আমি উঠলাম, তুই খেয়ে আমার রুমে আসিস। চাচি তুমি আমার সামনে খেয়ে নেও, আমি দুপুরে খাইনি বলে তুমিও তো দুপুরে খাওনি। তুই কোন কিছু খাছ নি আমি কি করে খাইরে বাবা, তুই না খেলে আমি বা তোর মা কোন দিন কি খেয়েছি? তা ঠিক তোমরা আমাকে অনেক আদর করো। তাই বলে কি আমি না খেলে তোমরাও খাবে না এটা কিন্তু ঠিক না চাচী। তুমি এখন আমার সামেনে কেতে বসো তার পর আমি এখান থেকে যাবো। ঠিক আছেরে বাবা আমি তোর সামনেই খেতে বসছি বলে রহিমের মা বসে পড়ল। ঠিক আছে চাচী তুমি কেয়ে নাও, আমি পড়তে গেলাম বলে ইমন চলে ইমন চলে গেল তার রুমে। পড়ার রুমে গিয়ে বৃষ্টির খাতাটি হাতে নিয়ে পালঙ্কে শুয়ে কি যে ভেবে একটি মুছকি হাসি দিল। অনেকক্ষণ শুয়ে থাকার পরে ইমন উঠে পড়ার চেয়ারটিতে বসে বৃষ্টির খাতা উল্টিয়ে পড়া গুলো বের করে নিজের বইয়ে মার্ক করতে শুরু করল। মার্ক করা শেষ হওয়ার পরে বৃষ্টির খাতাটি ভালো করে দেখে মনে মনে বলছে বৃষ্টি মনে হয় অনেক ট্যালেন্ট ছাত্রী, তা না হলে তার লেখা এতো সুন্দর হওয়ার কথা নয়। শিমুলটা কি না গাধা আর তার বোন বৃষ্টি কতো না ট্যালেন্ট। যাক এতো সব ভেবে সমসয় নষ্ট করে কোন লাভ নেই পড়াতে মন দেই বলে পড়তে শুরু করে। এদিকে রহিমের মা খাওয়া শেষ করে চলে যায় ইমনের মায়ের রুমে। আপা কি যেন বলবে বলেছিলে? না তেমন কিছু না। ভাত খেয়েছিস তুই? হ খাইছি। সকালের রান্না করার মতো কিছু আছে নি? লবণ নেই। সকালে রান্না করার আগে দোকান তেকে নিয়ে আসিস। আপা দোকানে যেতে আমার মনে চাই না। কেন? তুই কি জানিস না দোকানের কয়েকটি ছেলে আমাকে দেখলেই মুক্তিযোদ্ধের কথা জানতে চাই। মুক্তিযোদ্ধ কথাটি শুনলেই আমার সেই ভয়াবহ রাতের কথা মনে হয়ে যায় রে আপা, কি নির্মমভাবে ওরা আমার সামনে থেকে নিয়ে ফুটফুটে ছেলে আর স্বামীকে হত্যা করেছে আর আমাকে….. বলে একটি দীর্ঘশ্বাস ফেলে কেঁদে ফেলে রহিমের মা। এই শুরু করে দিলি তোর কান্না। বিকালে কি বললাম, এখনই ভুলে গেলি। আমি কি তোর থেকে কম ব্যথা নিয়ে বেঁচে আছি কই আমি তো কোনদিন কাঁদিনি। আপারে আমি যে ভুলতে পারিনা সেই রাতের কথা। ভুলতে হবে, ভুলতে না পারলেও ভুলার চেষ্টা করতে হবে। যুদ্ধের স্মৃথি গুলো যতোদিন তোর মাথায় থাকবে ততো দিন তোর চোখের জল শুকাবে না। চোখের জল তো সেই কবেই শেষ হয়ে এখন নতুন করে আর কিসের জল ঝরবে। তুই এভাবে কাঁদলে তো মরে যাবি আর কাঁদিস। কেঁদে কি কোন লাভ হবে। মরে কবেই গেছি রে আপা এখন পড়ে আছে শুধু লাশটা, মাটি তো দুরের কথা যে লাশ কে কোন কাক পক্কিও গ্রহণ করবে না বলে চোখ মুছতে মুছতে রহিমের মা তার রুমের দিকে চলে গেল। ফাতিমা খাতুন রহিমের মা চলে যাওয়ার সাথে সাথে হারিকেনের আলোটা নিভিয়ে দিল ঘুমিয়ে পড়ার জন্য। কারণ সকালে তার টিউশনি আছে তাই তারাতারি ঘুম থেকে উঠতে হবে। ইমন ততক্ষণে নিদ্রায় বিভোর হয়ে গেছে। রহিমের মা ঘরের টিম টিম করে জ্বলে থাকা হারিকেনের আলোটা নিভিয়ে বিচানায় শুয়ে আল্লাহর কাছে দোয়া করে হে আল্লাহ তুমি আমার স্বামী সন্তান কে দেখে রেখো।

তুমি ছাড়া ওদের যে আর কেউ নেই বলে ঘুমিয়ে পড়ে। সারা দিনের ক্লান্ত দিন মনে হচ্ছে রাতের গভীরতায় নিরভে নিজেকে একাকার করে দিয়েছে। বাড়ির সামনের বড় জারুল গাছটি থেকে রাত দুপুরে পাখির ডাক শুনা যাচ্ছে। পাখিটার করুণ ডাক শুনে মনে হয় কত সহ¯্র বছর ধরে তার সঙ্গিনীকে খুঁজছে আর গভীর রাতে নিরবে নির্ভৃতে দু’চোখের জল ঝড়চ্ছে। একটা সময় আছে পাখিটিও নিজের সঙ্গিনীকে হারিয়ে করুণ সুরে ডাকতে ডাকতে ক্লান্ত হয়ে রাতের আধাঁরে সাড়া দিয়ে নিরবে নিস্তদ্ধ হয়ে যায়। চারদিকের মসজিদ থেকে ফজরের আযানের ধব্বনি ভেসে আসছে। আরামের ঘুম থেকে উঠে সৃষ্টি কর্তার ইবাদত করার জন্য আস্সালা তো খাইরুন মিনান্নার, আস্সালা তো খাইরুন মিনান্নার বলে মোয়াজ্জিন মহল্লার সবাইকে ডাকছে। বাড়ি বাড়ি ভোরের ডাকে সাড়া দিয়ে ঘরের কোন থেকে মুরগির কক ককার কক…. কক ককার কক ডাক শুনা যাচ্ছে।

 

(পরবর্তি পর্ব ১২ জুন প্রকাশিত হবে)

শেয়ার করুন




 

 

 

 

© 2017-2022 All Rights Reserved Amadersunamganj.com
Design & Developed BY ThemesBazar.Com
error: Content is protected !!